ব্রাম্মণের প্রানরক্ষার ফল
ব্রাম্মনের প্রাণরক্ষার ফল কীর্তন প্রসঙ্গে রাজা দীননাথের নরমেধ যজ্ঞের বৃত্তান্ত :
সূতমুনি শৌনক মুনির প্রশ্নের উত্তরে বললেন-যে পুন্যের দ্বারা মানব পাপ মুক্ত হয়ে হরিধামে গমন করতে পারবে, আমি তা বলছি। ধনের দ্বারা অথবা প্রাণের দ্বারা যে মানব ব্রাম্মণের প্রাণ রক্ষা করে, সেই মানব বিষ্ণুলোকে গমন করে। তুমি শ্রবণ কর আমি এ সম্বন্ধে একটি পুরাতন ইতিহাস বর্না করব। পুরাকালে দ্বাপর যুগে এক রাজা ছিলেন, তাঁর নাম দীননাথ। তিনি অপুত্রক ছিলেন। মহামুনি গালব দীননাথের গৃহে উপস্থিত হলে তিনি তার বিধিমত সেবা করে জিজ্ঞাসা করলেন হে মহর্ষি, আমি হয়তো পূর্বজন্মে কোন পাপ কার্য় করেছি, তাই এজন্মে অপুত্রক হয়ে রয়েছি। হে ব্রাম্মণ এমন কোন কি পূণ্যকর্ম নেই , যার সাহায্যে আমার পুত্র লাভ হতে পারে? তেমন যদি কিছু থাকে তো আমাকে বলুন, আমি নিশ্চয় তা করব। যে মানুষের কোন পুত্র নেই, তার জীবনই অর্থহীন।
গালব মুনি দীননাথের প্রশ্নের উত্তরে বললেন-যদি তুমি নরমেধ যজ্ঞ করতে পার তাহলে সর্বগুনান্বিত পুত্রসন্তান লাভ করবে। নরমেধ যজ্ঞেই সকল যজ্ঞের প্রধান। যজ্ঞে বলি দেবে যার দেহ খুব সুন্দর, মনে সুন্দর, সর্বশাস্ত্রজ্ঞান যার আর সকুলে জন্ম, অঙ্গহীন, মূর্খ, কৃষ্ণবর্ণ দেহ, বলির জন্র তাকে গ্রহণ করবে না।
গালব মুনির উপদেশ পালন করবার জন্য রাজা দীননাথ তার দূতগনকে যজ্ঞের জন্য যেমন বলির প্রয়োজন সব বুঝিয়ে, উপযুক্ত ব্যক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে আদেশ করলেন।
বহুদেশ ঘুরে তেমন লোক না পেয়ে অবশেষে দশপুর নামে এক দেশে গিয়ে দূতেরা দেখল যে সেখানকার প্রত্যেক নারী পুরুষ সুন্দর দেখতে। সেই দেশে কৃষ্ণদেব নামে এক ব্রাম্মণ বাস করতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সুশীলা। তার তিন পুত্র। সেই ব্রাম্মণ পরম বৈষ্ণব ছিলেন। তিনি নিত্য বিষ্ণু পূজা করতেন।
যজ্ঞ করবার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। আপনি আপনার তিন পূত্রের মধ্যে যদি কোন একজকে দান করেন, তাহলে খুব উপকার হয়। রাজা আপনাকে সেই পুত্রের বিনিময় চতুর্লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে। আর আপনি যদি অর্থের বিনিময়ে পুত্রদের মধ্যে কোন একজনকে দান না করেন, তাহলে আমরা জোর করেই একজনকে নিয়ে যাব। কারণ আমরা রাজা-আজ্ঞাকারী।
ব্রাম্মনী এমন ভয়ানক কথা শুনে শোকে বিহবল হয়ে পড়লেন। তাঁর প্রনত্যাগ হবার উপক্রম হল। ব্রাম্মনী কাতর কন্ঠে বললেন-পুত্র ছাড়া কোন প্রয়োজ নেই।
ব্রাম্মণীর কথা শুনে রাজার দূতেরা ভীষণ রেগে গিয়ে তার গৃহে চারলক্ষ স্বর্মুদ্রা ফেলে রেখে তার জ্যেষ্ঠপুত্রকে নিয়ে যেতে উদ্যত হল, ব্রাম্মণ জোড় হাতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন-তোমরা যখন একান্তই ছাড়বে না, তখন জ্যেষ্ঠপুত্রকে রেখে অন্য কোন পুত্রকে নিয়ে যাও। ব্রাম্মণের কথায় দূতেরা তাদের জ্যেষ্ঠপুত্রকে ছেড়ে দিয়ে ব্রাম্মণীকে বলল-তাহলে, তোমাদের কনিষ্ঠ পুত্রকে দাও। নরমেধ যজ্ঞের জন্র আমরা তাকে নিয়ে যাই। ব্রাম্মণী তাদের কথা শুনে মাটিতে লটিয়ে পড়ে নিজের মাথায় করাঘাত করতে করতে কেঁদে বললেন-আমি আমার কনিষ্ঠ পুত্রকে ককনই দেব না।
তখন ব্রাম্মণের মধ্যম পুত্র মা-বাবাকে প্রণাম করে অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল-মা যদি বিষদান করে, পিতা যদি বিক্রয় করে, আর রাজা যদি সর্বস্ব হরণ করে নেন, তাহলে মানুষ কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে প্রতিকারের জন্য?
এই কথা বলে মধ্যম পুত্র রাজদূতদের সঙ্গে রাজার নরমেধ যজ্ঞের উদ্দেশ্যে চলে গেল। পুত্রের বিচ্ছেদে ব্রাম্মণ-ব্রাম্মণী কেঁদে কেঁদে অন্ধের মত হয়ে গেলেন।
রাজদূতেরা মধ্যম পুত্রকে নিয়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে উপস্থিত হল বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। মুনিবর তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে রাজদূতেরা অনুপূর্বিক সব ঘটনা বলল।
আসার পর এর পিতামাতার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এস তোমরা। রাজা আমকে তার নরমেধ যজ্ঞের পশু হিসাবে গ্রহণ করুক।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রের এই কথা শুনে রাজদূতেরা বলল-রাজ অনুমতি ছাড়া আপনাকে আমরা নিয়ে যেতে পারব না। তারা মহর্ষিকে এই কথা বলে মধ্যম পুত্রকে নেয়ে নরমেধ যজ্ঞাগারে উপস্থিত হল মহর্ষি বিশ্বমিত্র ও তাদের সঙ্গে সঙ্গে সেকানে উপস্থিত হলেন। রাজদূতেরা রাজাকে মুনির বক্তব্য বিষয়ে বললেন-রাজা শঙ্কিত হয়ে মুনির চরনতলে পড়ে বলল-হে মহর্ষি; আমাকে দিয়ে আপনি এমন যজ্ঞ করান যাতে বলিদান ছাড়াই আমি পুত্র অভ করি। তাহলে আপনি এই ব্রাম্মণপুত্রকে নিয়ে যেতে পারেন।
মহর্ষি বিশ্বমিত্র বললেন-হে রাজা,আমি যখন এসেছি আমার দর্শন যখন পেয়েছ, তুমি পুত্রলাভ করবেই। মহর্ষি বিশ্বমিত্র যজ্ঞের অন্যান্য ব্রাম্মণদের সঙ্গে নিয়ে কোন বলি ছাড়াই যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। তারপর মহর্ষি ব্রাম্মণ পুত্রকে সঙ্গে করে নিয়ে তার বাড়ীতে গিয়ে তার পিতাকে ডাকলেন-বাড়ি আছ বিবর?
ঘরের মধ্যে থেকে ব্রাম্মণ উত্তর দিলেন-হ্যাঁ আছি তবে মৃতবৎ। আমার পুত্রকে রাজ জোর করে নিয়ে গেল।এখন আর আমরা কি করবো? তাই মৃতের মতো অন্ধের মতো পড়ে আছি।
মহর্ষি বিশ্বামিত্র তখন বললেন-এই দেখ তোমার সেই পুত্রকে আমি নিয়ে এসেছি। একে গৃহে নিয়ে যাও। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্রাম্মণ-ব্রাম্মণী তাঁদের পুত্রের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাইরে বেরিয়ে এস মধ্যম পুত্রকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।
তারপর মুনির চরনে প্রনাম করে বললেন- হে মুনিবর, আপনি আমাদের জীবন দান করলেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্র তাদের আশীর্বাদ করে নিজের আশ্রমে চলে গেলেন।
কিছুকাল পরে রাজা দীননাথের একটি সুন্দর পুত্র জন্মগ্রহণ করল রাজা মহা আনন্দে প্রচুর ধন দান করলেন, যে মানুষ ধন বা প্রাণদান করে ব্রাম্মনকে পালন করে তার বিষ্ণুলোকে গতি হয়।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not share any links