Ad Code

Responsive Advertisement

ভক্তরাজ প্রহ্লাদের পূর্বজন্মের কাহিনী -ভক্তি রহস্য

 ভক্তরাজ প্রহ্লাদের পূর্বজন্মের কাহিনী -ভক্তি রহস্য

 

সূতমনিকে শৌনকাদি মুনিরা জিজ্ঞাসা করলেন-হে মহামুনি, ভক্তরাজ প্রহ্লাদ শিশুকাল থেকেই বাসুদেবের নাম স্মরণ করে তার ভক্তরূপে পরিণত হয়েছিলেন, এ কথা আমারা শুনেছি। কিন্তু যখন দেবাসুর যুদ্ধ আরম্ভ হয়, তখন সেই যুদ্ধে হরির সঙ্গে প্রহ্লাদ যুদ্ধ করলেন এবং তারই হস্তে নিহত হলেন। ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে এমন যুদ্ধ কেন ? আপনার অজানা কিছুই নেই। অতএব দয়া করে বলুন এবং আমাদের মনের সংশয় দূর করুন।

সূতমুনি বললেন-এই বিষয়টি পিতামহ ব্রম্মা মাহাত্ম ব্যাসের কাছে বর্না করেন। পরে এই বিষয়টি ব্যাসদেব প্রকাশ করেন। সেই কাহিনী ও ভক্তি রহস্য আপনারা এখন শ্রবণ করুন।

শিবশর্মা নামে একজন বেদজ্ঞ মহাযোগী পশ্চিম সাগর প্রান্তে দ্বারকাপুরীতে বাস করতেন। তিনি যোগবলে প্রত্যেকেই শাস্ত্রজ্ঞ এবং পিতৃভক্ত। সেই পুত্রদের নাম যজ্ঞ শর্মা, বেদশর্মা, বিষ্ণু শর্মা ও সোম শর্মা । শিবশর্মা চিন্তা করলেন- আমার প্রত্যেক পুএই পিতৃভক্ত আমি যা বলি, সঙ্গে সঙ্গে তা তারা পালন করে। একবার পরীক্ষা করে দেখি এদের। তারপর তিনি মায়া বিস্তার করে পুত্রদের সামনে ছল প্রদর্শন করে দেখলেন যে, তাদের জননী প্রবল জ্বরে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।

প্রত্ররা মাতার মৃত্যুতে গভীর দুঃখ পেল। তারপর পিতাকে বলল- পিতা, যার গর্ভে আমাদের জন্ম, তিনি নিজে দেখ ত্যাগ করে স্বর্গে গমন করেছেন। একন আমাদের কর্তব্য কি ? মাতার দেহ কিভাবে সকার করব ?

শিবশর্মা জ্যেষ্ঠপুত্র যজ্ঞশর্মাকে বললেন-তুমি একটি শানিত অস্ত্রের দ্বারা তোমার মৃত মাতার শরীর খন্ড খন্ড করে যত্র তত্র ছড়িয়ে দাও।

পিতার আদেশ শুনেই কোন কথা না বলে যজ্ঞশর্মা একটি তীক্ষ খড়ের সাহায্যে মায়ের মৃতদেহ খন্ড খন্ড করে একটি ঝুড়িতে করে যত্রতত্র ছড়িয়ে দিল। তারপর পিতার কাছে এসে বলল-আপনার আদেশ আমি যথাযথভাবে পালন করেছি পিতা। এবার অন্য কাজের জন্য আদেশ করুন। অতি দুষ্কর হলেও সেই কাজ আমি করব।

 

 

ভক্তি রহস্য
ভক্তরাজ প্রহ্লাদের পূর্বজন্মের কাহিনী -ভক্তি রহস্য

 

শিবশর্মা খুব খুশী হলেন যজ্ঞশর্মার এই কথা শুনে। বুঝলেন তাঁর প্রথম পুত্র প্রকৃতই পিতৃভক্ত। এরপর দ্বিতীয় পুত্র বেদশর্মাকে তিনি পরীক্ষা করবার জন্য ডাকলেন। বললেন- বেদশর্মা, তোমাদের মাতা একন পরলোকগতা, কিন্ত আমার অন্তর এখন কামানলে দগ্দ্ধ হচ্ছে। এই কথা বলে তিনি মায়াবলে বাড়ি থেকে কিছুদূরে এক সুন্দরী নবযৌবনা রমনী সৃষ্টি করে পুত্রকে দেখিয়ে বললেন-ওই যে নারীমূর্তি দেখতে পাচ্ছ, আমারই জন্য ঐ নারীকে তুমি অবশ্যই নিয়ে আসবে।

পিতার আদেশে বেদশর্মা পিতাকে প্রণাম করে সেই মায়া্-নারীর কাছে গিয়ে বলল-দেবী, আমার পিতা কামনার পীড়িত হয়ে আপনাকে প্রার্থনা করছেন। অতএব আপনি আমার বৃদ্ধ পিতার সেবাকার্য়ে নিযুক্ত হন।

মায়া-নারী বেদশর্মার কথা শুনে বলল-তোমার পিতা একজন বৃদ্ধ জরাগ্রস্থ শিথিলেন্দ্রিয়, আর আমি নবযৌবনা সুদর্শনা নারী। কখনই আমি তাকে সঙ্গ দান করতে পারব না। তুমি রূপ সৌভাগ্যবান, দিব্য লক্ষণাযুক্ত, মহাতেজা সুপুরুষ। আমি বরং তোমারই সেবা করব। তুমিই আমার এই অঙ্গ ভোগ করার যোগ্য।

মায়া-নারীর এমন পাপযুক্ত কথা শুনে বেদশর্মা বলল-দেবী আমাকে তুমি এমন কথা বলো না। আমি পিতৃভক্ত, পিতার জন্য আমি তোমাকে প্রার্থনা করছি। তুমি অন্রকথা বলো না, আমার পিতাকেই ভজনা করো। দেবী, তুমি যা চাইবে, যদি পৃথিবীতে দুর্লভ ওহয়, তবে স্বর্গরাজ্য থেকে এন দিতে পারি।

মায়া-নারী বলল-পিতার জন্র তুমি এতদূর করতে পার, তাহলে এখনই তুমি আমাকে ইন্দ্র ও মহাদেবকে দর্শন করাও। তুমি নিশ্চয় এই দুর্লভ সামগ্রী আমাকে প্রদান করবে। এই কথা শুনে বদেশর্মা ধ্যানরত হলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই দেবরাজ ইন্দ্র এবং দেবাদিদেব মহেশ্বর সেখানে উপস্থিত হলেন। বেদশর্মাকে বললেন-তুমি আমাদেরকে কি জন্য স্মরন করেছ? তুমি যা প্রার্থনা করবে, আমরা তা অবশ্যেই প্রদান করব। বেদশর্মা বলল-আমার প্রতি আপনারা যদি প্রসন্ন হয়, আমাকে তাহলে অমন পিতৃভক্তি প্রদান করুন। তখন ইন্দ্র ও মহাদেব তাই হবে বলে সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।

মায়া-নারী বলল-ব্রাম্মণ তোমার পন দেখলাম। আমার দেবতায় কোনো প্রয়োজন নেই। পিতার জন্য যদি তুমি আমাকে আকাঙ্খা কর, তাহলে তুমি নিজের হাতে নিজের মস্তক ছেদন করে আমাকে দাও। মায়া-নারীর কথা শুনে মহাআনন্দে

বেদশর্মা বলল-আমি ধন্য হলাম ঋন থেকে মুক্ত হলাম। এই আমি নিজের মস্তক ছেদন করছি, তুমি ধর, এই কথা বলে, বেদশর্মা নিজের মস্তক কেটে মায়া নারীর হতে দিল। মায়া-নারী বেদশর্মার কাটা মাথা নিয়ে শিবশর্মার কাছে গিয়ে বলল-ব্রাম্মণ, আপনার পুত্র বেদশর্মা আপনার জন্য নিজেই নিজের মস্তক ছেদন করে পাঠাল। আপনি এটি গ্রহণ করুন। আপনার সেই পিতৃভক্ত পুত্র আপনার জন্য নিজেই নিজের মস্তক ছেদন করে পাঠাল। আপনি এটি গ্রহণ করুন। আপনার সেই পিতৃভক্ত পুত্র আপনার জন্যই আমায় এই উত্তমঙ্গ দিয়েছে, অতএব আমায় আপনি উপভোগ করুন।

মায়া-নারীর মুখে এই কথা শুনে বেদশর্মার দুই ভাই ভায়ের এই সাহস দেখে কাঁপতে কাঁপতে বরাবলি করতে লাগল-আামার মাতা সদ্য প্রনত্যাগ করছেন। আর এই ভাই আমাদের পিতার জন্য প্রাণত্যাগ করল। অবশেষ ধন্যবাদের যোগ্য আমাদের এই ভাই। ব্রাম্মণ শিবশর্মা প্রত্রদের মুখে এই কথা শুনে বুঝলেন যে, প্রকৃতই পিতৃভক্ত বেদশর্মা। ভক্তিবলেই সে নিজের মস্তক ছেদন করেছে। এরপর তিনি তার তৃতীয় পুত্র ধর্মশর্মাকে বললেন-এই ভ্রাতারা মস্তক গ্রহণ কর। পিতার আদেশ পালন করবার জন্য ধর্মশর্মা ভ্রাতার মস্তক নিয়ে বাড়ির বাইরে এস যোগসাধনা শুরু করল। তপস্যা ও সত্যবলে যমরাজ ধর্মের আরাধিনা করল। ধর্মরাজ তার সামনে আবির্ভূত হলে তিনি বললেন- হে ধর্মশর্মা, তুমি কিসের জন্য আমার আরাধনা করলে? আমায় কি করতে হবে বল ? সুব্রত, তোমার তপস্যা ও পিতৃভক্তি দেখে অতি প্রসন্ন হয়েছি আমি। তুমি তোমার ভ্রাতা বেদশর্মার ছিন্ন মস্তকটি তার ছিন্ন দেহের সঙ্গে যুক্ত কর, আমার বর-প্রভাবে আবার জীবন লাভ করবে। এখন তুমি অন্য কোন দুর্লভ বর প্রার্থনা কর। ধর্মরাজার কথা শুনে ধর্মশর্মা বলল যদি আপনি প্রসন্ন হয়ে থাকে তবে আমার পিতার পাদ পূজনে অচল ভক্তি ধর্মে অুনরাগ এবং অন্তে মোক্ষধাম প্রার্থনা করি। তোর সমস্তই মনোবাসনা পূর্ণ হবে এমন কথা বলে ধর্মরাজ সেকান থেকে অন্তর্হিত হলেন।

তারপর ধর্মশর্মা বেদশর্মার ছিন্ন মস্তকটি দেহের সঙ্গে যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই দেবশর্মা যেন ঘুম থেকে উঠে বলল সেই দেবী কোথায় গেলেন ভাই ? আর পিতাই বা কোথায় আছেন ? তার উত্তরে ধর্মশর্মা তাকে সব কথা বলে পিতার সামনে উপস্থিত হল দুই ভাই ।তারপর ধর্মশর্মা পিতাকে বলল পিতা, আমি আপনার পুত্রকে গ্রহণ করুন। শিবশর্মা পুত্রের পিতৃভক্তির পরিচয় পেয়ে কোন, কথাই বললেন না। আবার চিন্তা করে চতুর্থ পুত্র বিষ্ণুশর্মাকে ডেকে বললেন –পুত্র,

আমি বৃদ্ধ জরাতুর, ইন্দ্রিয় শিথিল। কিন্ত আমি এই কামিনীর সহবাস ইচ্ছা করি । এই ললনা আমার সহবাস ইচ্ছা করছেনা। আমি যাতে একে লাভ করি তুমি তাই করো। আমি জানি সমুদ্র মন্থনে যে অমৃত উঠেছিল, সেই অমৃত সর্বব্যাধি দূর হয়, কৃৎসিতকে সুন্দর করে, বৃদ্ধকে যুবায় পরিণত করে, অতএব সুরপুরে গিয়ে তুমি আমার জন্য অমৃত আন। আমি সেই অমৃত সেবন করে এই কামিনীর সঙ্গে পরম আনন্দ উপভোগ করি। বিষ্ণুশর্মা পিতার এমন কথা শুনে বলল- পিতা, আপনার সুখকর সকাল উত্তম কার্য়ই আমি করতে প্রস্তত আছি। এই কথা বলে পিতাকে প্রনাম করে উত্তম বলে, তপস্যা ও নিয়ম প্রভাবে অন্তরীক্ষ পথে অগ্রসর হল। ক্রমশঃ সে গগনান্তরে প্রবেশ করল। বিষ্ণুশর্মার উদ্দেশ্য জানতে পেরে দেবরাজ ইন্দ্র চিন্তা করলেন, এই যুবক সাধনা বলে স্বর্গের অমৃত মর্তে নিয়ে যাবে আর মর্তবাসীরা অমর হয়ে থাকবে, তা আমি কখনো হতে দেব না। যেমন করেই হোক স্বর্গে আমায় বাধা দিতেই হবে। এই চিন্তা করে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গে আসছে। যেমন করেই হোক তুমি তার গতি রোধ কর। ইন্দ্রের কথা শুনে মেনকা নন্দনকাননে গিয়ে বীনা বাজিয়ে মধুর স্বরে গান করতে শুরু করল। মেনকাকে দেখতে পেয়ে তার উদ্দেশ্য বুঝতে বিষ্ণুশর্মার আর বাকী থাকলনা। যে সুধা আনার জন্য বিঘ্ন ঘটাতেই সে এভাবে ওত পেতে বসে আছে। কাজেই তার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই সে তাড়াতাড়ি চলতে লাগল।

তারপর শিবশর্মা সস্ত্রীক আপন পুণ্যপ্রভাবে বিষ্ণুলোকে যাত্রা করলেন। মহাত্মা সোমশর্মা তার পর তপস্যা শুরু করলেন।আহারাদি সংযম করে, কারো কাছে কিছু ভিক্ষা না করে অযাচিতভাবে যা পায় তাতেই সে জীবন রক্ষা করে। ক্রমশঃ তার মৃত্যুকাল উপস্থিত হল। এইবার স্বয়ং ভগবান তাকে পরীক্ষা করার জন্য তার কাছে কতগুলি দৈত্যকে পাঠালেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত সোমশর্মা তার চারপাশে দৈত্যদের উচ্চস্বরে কথা শুনে তাদের দেখে ভয়ে ভীত হয়ে পরলোক যাত্রা করল। দৈত্যভয়ে ভীত হয়ে মৃত্যুর জন্য সেই মহাত্মা সোমমর্মাকে দৈত্যগৃহে হিরণ্যকশিপুর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করতে হল। পূর্বতন যোগাভ্যাসের জন্র সে জতিস্মর হল। পূর্বের সবকথা চিন্তা করে সে ভাবল- সারাজবিন ধর্মপথে থেকে শুধুমাত্র মৃত্যুর সময় দৈত্যদের দেখে দেহত্যাগ করার জন্য দৈত্যকুলে আমাকে জন্মগ্রহণ করতে হল। তাহলে এবার যদি আমি বিষ্ণুর হাতে মৃত্যুবরণ করি তাহলে দিব্যগতি লাভ করতে পারব।সবসময়েই সে এই চিন্তা করত। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় ভগবান বলেছেন, মৃত্যুর সময় যে যেইভাবে স্মরণ করে মরবে, পরের জন্মে সে সেই ভাব নিয়েই জন্মাবে।

ভগবান তার অভীষ্ট পূরণও করেছিলেন। ঘোরতর দেবাসুর তিনি চক্রপানির হাতে নিহত হলেন।এমন গুনবন্ত পুত্র নিহত হওয়ার কারনে তার মা কমলা পুত্রের জন্য খুব কাদলেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললেন-ভগবান শ্রীহরি তোমার পুত্রের ইচ্ছাতেই তাকে নিধন কজরেছেন। আবার তোমার গর্ভেই সেই পুত্র জন্মলাভ করবে। তুম দুঃখ করোনা আর কারো কাছে এই বিষয়ে প্রকাশ করো না। তোমার ওই পুত্রের অসুরভাব থাকবে না। দেবভাবে অন্বিত হবে, সকল দেবতারও নমস্য হবে। তুমি সর্বদা সেই পুত্রের দ্বরা সুখলাভ করবে। এই বলে দেবর্ষি চলে গেলেন।

তারপর যথাসময়ে কমলার গর্ভে প্রহ্লাদের জন্ম হল। বাল্যকাল থেকেই কৃষ্ণধ্যান করতে লাগল। ভগবান শ্রীহরি তার জন্যই হিরণ্যকশিপুর নৃসিংহমূর্তি ধারণ করে বধ করলেন।

সমাপ্ত

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Close Menu