Ad Code

Responsive Advertisement

রেবা -মাহাত্য

 

 রেবা -মাহাত্য

প্রমোহিনী, সুশীলা, সুস্বরা, সুরারা আর চন্দ্রিকা এই পাঁচজন গন্ধর্ব-কুমারী পরস্পর পরস্পরকে খুব ভালোবাসত। তারা যেন পাঁচ বোনের মত। সকলেই রূপবতী। তারা ভাব-নৃত্য এবং বেনু-বীনাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে সকলেই দক্ষ। একবার বৈশাখ মাসে দেবী গৌরীর আরাধনা করার ইচ্ছায় পঞ্চসখী মিলিত হল। নানা পুষ্প চয়ন করতে করতে বনে ভ্রমণ করে অবশেষে তারা অচ্ছেদ সরোবরে উপস্থিত হল। তারপর মাটি দিয়ে গৌরীর মূর্তি গড়ে সোনা-মুক্তো দিয়ে ভূষিত করে বিভিন্ন কৌশলে নৃত্যও করল তারা। তারপর পাঁচসখী মধুর স্বরে গান শুরু করল।

যখন তারা সঙ্গীতের রসে একেবারে নিমগ্ন, এমন সময় মুনিবর বেদনিধির জ্যেষ্ঠ পুত্র তীর্থ প্রবর স্নান করার জন্য আচ্ছেদ সরোবরে এসে উপস্থিত হল। মদনকেও যেন হার মানায় তার রূপ। তীর্থ প্রবরকে দেথে পাঁচ গন্ধর্ব কুমারী মনে মনে ভাবছে- এই ব্যক্তি বোধ হয় আমাদের অতিথি হবে। তখন তারা নৃত্য-গীত ছেড়ে এসে আরও ভালভাবে এই যুবককে দেখার জন্য উৎসুক হল। কারও চেখের যেন পলক পড়ছে না।তারা মনে মনে বিচার করছে এই পুরুষ কি রতিপতি মদন। আবার ভাবছে, যদি মদন হত তাহলে তার সঙ্গে নিশ্চয় রতি থাকতো। অশ্বিনীকুমার যুগল ও নয়। তারা সবসময় যুগ্মচারী, অর্থাৎ কেউ তারা একা একা হয়ে থাকে না। তাহলে এ যুবক নিশ্চয় কোনও গন্ধর্ব, কিন্নব সিদ্ধ অথবা কোন কামরূপধারী হবে। কোন ঋষিপুত্রও হতে পারে, গন্ধর্বকুমারীগণ ভাবছে-গৌরী আমাদের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে, আমাদের জন্য এই রূপবান বরকে পাঠিছেন। তখন পাঁচ কুমারীই এই বাক্য উচ্চারণ করল- “আমি একে বরণ করলাম।” ঋষিপুত্র তীর্থপ্রবর স্নান, তর্পণ, মধ্যাহ্নিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে সেই কুমারীদের কথা শুনে মনে মনে চিন্তা করল- কি আশ্চর্য়! ব্রম্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, প্র্রভৃতি দেবগন, যোগাবলম্বী মুনিগণ ও রমনীদের নীলাদ্বারা বিমোহিত হন। ধর্মরক্ষণের চেষ্টা করেও আমি তাদের দ্বারা মোহিত হচ্ছি। আমার এখন কর্তব্য হেচ্ছে এরা আমার কাছে আগে আমার গৃহে ফেরা উচিত।

রেবা -মাহাত্য

এই চিন্তা করে ঋষিকুমার যোগবলে হঠাৎ অদৃশ্য হয়েগেল। এই দৃশ্য দেখে পাঁচকুমারী শূন্যহৃদয়ে দশদিক অন্ধকার দেখতে লাগল। তারা তখন পরস্পর বলাবলি করল এ নিশ্চয় ইন্দ্রজাল অথবা মায়াজাল। নচোৎ এইতো দেখলাম, তাহলে আবার অদৃশ্য হল। কেমন করে? হয়! কি কষ্ট। বিধাতা কেনই বা তোমাকে দেখালেন, আর এখানেই বা আনরেন কেন? তোমার চিত্ত কি দয়াহিন? আমাদের প্রতি কি তোমার মন নেই? কি নিষ্ঠুর তুমি। আমাদের মনহরণ করে তুমি কি আমাদের পরীক্ষা করছ? হে হৃদয়েশ্বর, যদি তোমার আর দেখা না পাই, তাহলে আমরা আর বাঁচব না। তুমি আবার ফিরে আসবে এই আশায় এখনও আমরা জীবিত আছি। যেখানে তুমি আছ, সেখানেই আমাদের কে নিয়ে চল।কণ্যাগণ এইভাবে বিলাপ করেও যখন ঋষিপুত্রের আর দেখা পেল না, তখন নিজ নিজ পিতার ভয়ে তারা নিজেদের গৃহের দিকে যেতে শুরু করল। অপরাহ্নে সকলেই গৃহে ফিরলে, তাদের মা নিজ নিজ কণ্যাকে জিজ্ঞাসা করল- এত দেরী হাবর কারণ কী?

তারা উত্তরে বলল আচ্ছেদ সরোবরে কিন্নরীগনের সঙ্গে খেলা করতে করতে এত বেলা হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। কারোই যেন কথা বলার ইচ্ছা নেই। কখন তারা মাটিতে শয়ন করল। জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। কখন বা বিছানায় পড়ে কাঁদল। আহারে তাদের কোন রুচি নেই। এইভাবে জ্বরাক্রান্তের মতো সেই রাত্রিটি কোনমতে দৈর্য়্য ধরে কাটাল।রাতে কারো চোখের ঘুম আসে না। সেই মুহুর্তে পূর্বাকাশে সূর্য়োদয় লক্ষ্য করল, আর ঘরে মন থাকল না। নিজ নিজ মাংয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে আবার গৌরী পূজার জন্য বেরিয় পড়ল। সেই সরোবরে স্নান করে আগের মতো ধূপদীপ দিয়ে গৌরী পূজা করে নৃত্যগীত শুরু করল।

 

সেই ঋষিকুমার আগের দিনের মতো স্নানের জন্য আচ্ছেদ সরোবরে উপস্থিত হলে সেই কণ্যাগন অতি আনন্দের সঙ্গে তাড়াতাড়ি কুমারের কাছে গিয়ে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে এক বেষ্টনী তৈরী করে তাকে বদ্ধন করল। তারপর বলল-প্রিয় আগের দিন তুমি চলে গিয়েছ। কিন্তু আজ আর যেতে পারছ না। আমরা তোমাকে হরণ করেছি।

তখন ঋষিকুমার বলল-ভাল কথাই তোমরা বলছ, কিন্তু আমি ব্রম্মচারী। বিদ্যাশিক্ষা লাভের জন্য গুরুকুলে বাস করি, তোমাদেরকে আমি যদি বিবাহ করি, তাহলে আমার ধর্ম নষ্টহবে। যে আশ্রমে যেমন ধর্ম বিহিত আছে, পন্ডিতগনের তা পালন করা উচিত। তাই আমি এই বিবাহ ধর্ম বলে মনে করির না।ঋষিকুমারের এই কথা শুনে সেই কণ্যাগণ বলল-ধর্ম থেকে অর্থ, অর্থ থেকে কাম এবং কাম থেকে সুখরূপ ফল সৃষ্টি হয়। তোমার ধর্ম বাহুল্য প্রযুক্ত সেই কাম সামনে উপস্থিত। তাই নানাবিধ ভেগসহ তার সেবা কর।

 

ঋষিকুমার বলল- সত্য বটে তোমাদের বাক্য। কিন্ত আমি আবশ্যক ব্রত সম্পন্য করে গুরুদেবের অনুমতি নিয়ে তবেই বিবাহ করব। এর অন্যথা কখনো করতে পারব না।

তার উত্তরে কণ্যাগণ বলল- তুমি সুন্দর, কিন্তু মুর্খ। বেদজ্ঞ সুধী ব্যক্তির সিদ্ধ ঔষধ, সিদ্ধ রসায়ন, সিদ্ধ মন্ত্র, সিদ্ধ রস-এই সবই ধর্মতঃসেব্য। কার্য়্য যদি দৈবকনত সিদ্ধি লাভ করে, তবে নীতিজ্ঞ ব্যক্তি তাতে উপেক্ষা করে না। কারণ উপেক্ষা কখনই ফলপ্রদ হয় না।তাই আর দেরী করা উচিত নয়, বিষ থেকেও অমৃত গ্রহণ করা উচিত। অপবিত্র স্থান থেকেও কাঞ্চন গ্রহণ করা কর্তব্য, নচের কাছ থেকেও উত্তম বিদ্যা শিক্ষনীয়, এক নচিকুল থেকেও স্ত্রীরত্ব গ্রহণ করা উচিত। একাই সব কারনে তুমি এই মঙ্গলকর্ম স্বীকার কর, এখন গন্ধর্ব বিবাহ ছাড়া আমাদের বাঁচবার আর কোন উপায় নেই।

 

কুমারীদের এমন কথা শুনে ঋষিকুমার বলল-অর্থ, মোক্ষ, কাম, ধর্ম-এই চারটি যথাক্রমে উপাসিত হলে ফলপ্রদ হয়। তার বিপরীত হলে নিষ্ফল হয়। আমি ব্রতী, অকালে দার পরিগ্রহ করব না। যে জন ক্রিয়াকাল জানে না, সে ক্রিয়াকাল পায় না।

ঋষিকুমারের এমন কথা শুনে প্রমোহিনী হাত ছেড়ে দিয়ে ঋষি কুমারের পদযুগল ধরল। সুশীলা ও সুস্বরা তার দুই বাহু ধরল। সুস্বরা তাকে আলিঙ্গন করল। আর চন্দ্রিকা তার মুখে চুম্বন করতে লাগল।

তবুও সেই ঋষিকুমার নির্বিকার। কিন্তু পরে সেই ব্রম্মচারী প্রচন্ড ক্রোধে পাঁচ কুমারীকে অভিশাপ দিল-তোরা আমার সঙ্গে পিশাচীর মত ব্যবহার করলি, তাই তোরা পিশাচী হবি।

এই অভিশাপ শুনে কুমারীগন অতি ক্ষেভের সঙ্গে বলল-তোর হিতের জন্য আমরা চেষ্টা করলাম, আর তুই কিনা আমাদের অভিশাপ দিলি, আমরাও তোকে অভিশাপ দিচ্ছি, তুই ও পিশাচ হবি।

এইভাবে পরস্পর শাপ প্রদানের ফলে পাঁচ কুমারী আর ঋষিকুমার পিশাচত্ব লাভ করল। তারা তকন দারুন ক্লেশে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তাদের সবার পিতামাতা তাদের এই দশা দেখে গভরি শোকে মুহ্যমান হল। পরে এই পিশাচ-পিশাচীরা সেই সরোবরের তীরে আহার সন্ধানের জন্য হতস্ততঃ ছোটাছুট করে অতি দুঃখে বাস করতে লাগল।

এই ভাবে বহুকাল কেটে যাবার পর সদৃচ্ছ বিচরনকারী মহর্ষি লোমশ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তকন তাকে- ভক্ষণ করার জন্য সেই পিশাচ ও পিশাচহগন তার দিকে ধাবিত হল। কিন্তু মুনিবরের তেজে তাদের সকলের গা যাচ্ছিল, তাই কেউ তার কাছে যেতে পারল না। সকলে দূরেই দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু সেই ঋষিকুমার পূর্বজন্ম প্রভাবে মুনিবরের চরনে সষ্ঠাঙ্গ প্রণা্ম জানিয়ে বলল-হে বিপ্র মহাবাগ্যের ফলে সাধুসঙ্গ লাভ হয়।

    তারপর সেই পিশাচ কিভাবে ব্রম্মচারী থেকে পিশাচত্ব লাভ করল, সবকিছু লোমিশ মুনিকে বলল। লোমশ মুনি সব কথা শুনে বললেন- তোমরা সবাই আমার সঙ্গে রেবা নদীতে স্নান কর, সকরের অবশ্যই রেবা নদী শাপমুক্ত করবে। রেবা স্নানে সকলের পাপ নাশ হয়, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। পন্ডিতগন যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত দেখতে পান ন, সেই সমস্ত পাপ নের্মদা অর্থাৎ নদীতে স্নানের ফলে বিনষ্ট হবেই হবে। নের্মদা স্নানের ফলে নানব আর গর্ভবস করে না, মুক্তিলাভ করে।তখন সেই পিশাচ-পিশাচীরা মুনির সঙ্গে নর্মদার তীরে গিয়ে উপস্থিত হলে এক প্রচন্ড বায়ু প্রবাহের দ্বারা সেই নর্মদার জলকনা তাদের অঙ্গ স্পর্শ করল। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পিশাচত্ব দূর হয়ে গেল। তারা দিব্য দেহ ধারণ করে বহু প্রশংসা করল নর্মদার। তারপর মহর্ষি লোমশের আদেশ অনুসারে ঋষিকুমার ঐ গন্ধর্বকুমারীদের বিবাহ করে নর্মদার তীরেই বসবাস করতে লাগল। আর নর্মদাকে অর্চনা করে তারা বিষ্ণুলোকে গমন করল।

* সমাপ্ত *

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Close Menu